মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ

মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আশা-হতাশার দোলার শেষে বাংলাদেশের হার
জয়টা হাত থেকে ফসকে গেল বাংলাদেশের ছবি

১৪০ রানে যখন বোলাররা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আটকে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের মেয়েদের জয় নিয়ে আশা জেগেছিল। হঠাৎই ৩ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের যখন ৫ উইকেট পড়ে গেল ৬০ রানে, মনে হলো বাংলাদেশের আর টানা দ্বিতীয় জয়টা পাওয়া হচ্ছে না। আবার দুটি ২৫ রানের জুটিতে আশা জেগেছে, আবার অন্য পিঠে উইকেটের পতন হতাশা ছড়িয়েছে।

মাউন্ট মঙ্গানুয়েই আজ আশা-হতাশার এই দোলাচল শেষ মুহূর্ত পর্যন্তই তো ছিল! বাংলাদেশের দশম ব্যাটার ফারিহা বোল্ড হওয়ার আগের বলটি পর্যন্তও মনে হচ্ছিল, বুঝি কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে। বুঝি বাংলাদেশ জিতে যাচ্ছে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হলো না, ৪ রানে হেরে গেছে বাংলাদেশ।

আশা-হতাশার দোলাচলটা কেমন, তা বোঝাতে এতটুকুই সম্ভবত যথেষ্ট যে, শেষ ওভারে বাংলাদেশের হাতে যখন ১ উইকেট, দরকার যখন আর ৯ রান, তখনো জয় নিয়ে আশা না দেখা মানুষ হয়তো খুব বেশি ছিলেন না।

৮৫ রানে ৭ উইকেট হারানো বাংলাদেশ যে এতদূর আসতে পারবে, তা-ও বা কজন ভেবেছিলেন! ১১০ রানে সালমা খাতুনকে হারানোর পরও এক প্রান্তে নাহিদা আক্তার ছিলেন, তাঁর ব্যাটেই জয়ের স্বপ্ন ছিল।

জাহানারার বিদায়ে ১২২ রানে নবম উইকেট হারানোর পর শেষ ব্যাটার ফারিহাকে নিয়ে দারুণ লড়ে গেছেন নাহিদা। প্রতি ওভারের শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রেখেছেন।

২ ওভার বাকি থাকা অবস্থায়ও বাংলাদেশের জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রানের সংখ্যা বাকি থাকা বলের চেয়ে কম ছিল। কিন্তু ৪৯তম ওভারে ডটিনের ছয় বলে এল মাত্র দুই রান। একটি ওয়াইড, আরেকটি ওভারের শেষ বলে নাহিদার সিঙ্গেল। তবু শেষ ওভারেও জয়ের স্বপ্ন নিয়েই গিয়েছিল বাংলাদেশ।
আউট হয়ে ফিরছেন বাংলাদেশের ব্যাটার ফারজানা

৬ বলে দরকার তখন ৮ রান, কিন্তু বাংলাদেশের ভরসা হয়ে নাহিদা তখনো স্ট্রাইকে। প্রথম বলেই দ্রুত দৌড়ে দুই রান নিয়েছেন নাহিদা। ঝুঁকি ছিল, কিন্তু ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া বাংলাদেশের উপায়ও নেই। কিন্তু দ্বিতীয় বলে দুই রান নিতে গিয়ে আর হলো না, এক রান এল।

সমীকরণ-৪ বলে ৫ রান দরকার, কিন্তু স্ট্রাইকে তখন শেষ ব্যাটসম্যান ফারিহা। স্ট্রাইক ছেড়েই বুঝি ভুলটা করে ফেললেন নাহিদা। তৃতীয় বলে বোল্ড ফারিহা! খুব কাছে গিয়েও জয়টা পাওয়া হলো না বাংলাদেশের।

অথচ বোলাররা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মাত্র ১৪০ রানে আটকে দেওয়ার পর বিশ্বকাপে বাংলাদেশের মেয়েদের টানা দ্বিতীয় জয়ের স্বপ্ন জেগেছিল। আগের ম্যাচে পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকাপে নিজেদের ইতিহাসে প্রথম জয়ের গল্প লেখা বাংলাদেশ আজ জয়টা পেয়ে গেলে সেমিফাইনালে যাওয়ার কাগুজে সম্ভাবনাও বেড়ে যেত।

কিন্তু মিডল অর্ডারে জুটি গড়ার পর একসঙ্গে দুটি-তিনটি করে উইকেট হারিয়ে নিজেদের পায়েই কুড়াল মেরেছেন মেয়েরা।১৪১ রানের লক্ষ্যে শুরুটাও ভালো হয়নি বাংলাদেশের। ইনিংসের পঞ্চম বলেই আউট শামিমা সুলতানা।

৪৮ বল পর দলকে ৩০ রানে রেখে ফিরলেন আরেক উদ্বোধনী ব্যাটার শারমিন আক্তারও। তৃতীয় উইকেটে ফারজানা হক (২৩) ও অধিনায়ক নিগার সুলতানা (২৫) যখন জুটিটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল, ম্যাচটা তো বাংলাদেশের মেয়েদের নিয়ন্ত্রণেই। কিন্তু জুটিতে ৩০ রান হওয়ার পর এক পলকে নিয়ন্ত্রণ ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতে! স্কোরবোর্ডে কোনো রান যোগ না করে ১২ বলের মধ্যেই ৩ উইকেট হাওয়া!

এক অ্যাফি ফ্লেচারই মুড়িয়ে দিলেন বাংলাদেশের মিডল অর্ডার। ২২তম ওভারে তাঁকে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গেলেন ফারজানা। এরপর ফ্লেচারের পরের ওভারে পরপর দুই বলে আউট রুমানা আহমেদ ও রিতু মনি!

হ্যাটট্রিক হয়নি ফ্লেচারের, বাংলাদেশের ইনিংসের ‘ধারা’ মেনে এরপর আরেকটা জুটি হয়েছে। এতক্ষণ ক্রিজের অন্য প্রান্তে থেকে তিন ব্যাটারকে আসা-যাওয়া করতে দেখা অধিনায়ক নিগার ষষ্ঠ উইকেটে সালমা খাতুনকে (২৩) নিয়ে গড়লেন ২৫ রানের জুটি। আবার বাংলাদেশের জয়ের আশা জেগেছে। কিন্তু আরেকবার জোড়া উইকেটের ধাক্কা! এবার ধাক্কাটা দিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের আরেক স্পিনার—অফ স্পিনার হেইলি ম্যাথুস। ৩৩তম ওভারের দ্বিতীয় বলে হেইলির বলে এলবিডব্লু নিগার।

আম্পায়ার অবশ্য প্রথমে আউট দেননি, রিভিউ নিয়ে সাফল্য পায় ক্যারিবীয়রা। তার দুই বল পর হেইলির বাতাসে ভাসানো বল পড়তে না পেরে বোল্ড ফাহিমা খাতুন। ৮৫ রানে ৭ উইকেট নেই! বাংলাদেশের জয়ের আশা তখন অস্তগামী।

এবারে অন্য প্রান্তে থেকে দুই ব্যাটারকে আউট হতে দেখা সেট ব্যাটার সালমার জুটি গড়ার পালা। অষ্টম উইকেটে ২৫ রানের জুটি গড়লেন নাহিদা আক্তারের সঙ্গে। কিন্তু বাংলাদেশকে ১০০ পার করানোর পর বলতে গেলে উইকেটটা বিলিয়েই দিয়ে এলেন সালমা।

মিডউইকেটে ক্যাচিং অনুশীলন করিয়ে সালমা (২৩) যখন ফিরছেন, বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ১১০। জয় তখনো ৩১ রান দূরে, বল তখনো বাকি আরও ৪১টি, কিন্তু হাতে যে মাত্র ২ উইকেট।

এক প্রান্তে নাহিদা দেখেশুনে সময় নিয়ে খেলছিলেন, কিন্তু তাঁকে না কেউ সঙ্গ দেওয়ার মতো ছিলেন, না কেউ আগ্রাসনের কাজটাও করতে পেরেছেন। বল আর রানের ব্যবধান কমে আসছিল। বাংলাদেশের তখন জোড়া চ্যালেঞ্জ। রানও তুলতে হবে দ্রুত, কিন্তু ওদিকে উইকেটও যে হাতে বেশি নেই!

জাহানারা চ্যালেঞ্জটাতে উতরে যেতে পারলেন না। ১০ বলে ১ চারে ৮ রান করার পর মারতে গিয়েই ক্যাচ তুললেন টেলরের বলে, ব্যাটে-বলে সংযোগটা ঠিকমতো হয়নি। মিড অন থেকে দৌড়ে এসে রামহ্যারাক ক্যাচটা ধরে ফেললেন। বাংলাদেশ ৯ উইকেটে ১২২। তখনো ২৭ বলে ১৯ রান দরকার, হাতে থাকা বাকি উইকেটে নাহিদার সঙ্গী শেষ ব্যাটসম্যান ফারিহা।

৪৭তম ওভারের প্রথম বলে ডটিনকে চার মারলেন নাহিদা, বাংলাদেশের সমীকরণ নেমে এল ২৩ বলে ১৪ রানে। এর মধ্যে অবশ্য ম্যাচে বিরতি এল। ৪৭তম ওভারের পঞ্চম বলে ঝাঁপিয়ে নাহিদার রান আটকাতে গিয়ে ব্যথা পেলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্যাম্পবেল। পেট চেপে ধরে মাঠে পড়ে রইলেন, অ্যাম্বুলেন্স এল।

প্রায় ১০ মিনিটের মতো ম্যাচ বন্ধ থাকল। আবার খেলা শুরু হতে নাহিদা স্ট্রাইক ধরে রাখার কাজটা করেছেন, প্রতি ওভারের শেষ বলে সিঙ্গেল নিয়েছেন। কিন্তু শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলে সিঙ্গেল নিয়েই ভুলটা করে ফেললেন!

এর আগে শ্যামিন ক্যাম্পবেলের অপরাজিত অর্ধশতকে (৫৩) ভর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ শেষ দিকে ইনিংসে গতি বাড়িয়েছে। ৩৬তম ওভারের তৃতীয় বলে সপ্তম উইকেট হারানোর সময়েও ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান ছিল মাত্র ৭০।

শেষ ১৫ ওভারে রানটাকে দ্বিগুণ করেছে, অলআউটও হয়নি, সবই তো ক্যাম্পবেলের সৌজন্যে। অষ্টম উইকেটে ৩২ রানের জুটিতে তবু অ্যাফি ফ্লেচার (১৭) কিছু অবদান রেখেছেন ক্যাম্পবেলের সঙ্গে, নবম উইকেটে ৩৬ রানের জুটিতে তো কারিশমা রামহ্যারাকের অবদান মাত্র ৭!

বাংলাদেশের হয়ে রিতু মনি (৩ ওভারে ১৫ রান) ছাড়া কেউই চারের ওপর রান দেননি। রিতুর ১ উইকেটের পাশাপাশি উইকেট পেয়েছেন সালমা (২টি), নাহিদা (২টি), জাহানারা (১টি) ও রুমানা (১টি)।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসে ১৩তম ওভারের তৃতীয় বল থেকে শুরু করে ৪৩তম ওভারের দ্বিতীয় বল—প্রায় ৩০ ওভারে বাউন্ডারি এসেছে মাত্র একটি! ইনিংসে ১২ বাউন্ডারির সবই ওয়েস্ট ইন্ডিজ মেরেছে শুরু আর শেষে। এর মধ্যে ৫টিই ক্যাম্পবেলের। অবশ্য লেগ বাই থেকে ৪ আর ওয়াইডে ৫ রানও অতিরিক্ত পেয়েছে তারা।

১২টি বাউন্ডারি এসেছে বাংলাদেশ ইনিংসেও। বাউন্ডারি-খরা অত লম্বা হয়নি নিগার সুলতানাদের, শুধু ২২তম ওভারের দ্বিতীয় বল থেকে ৩৬তম ওভারের চতুর্থ বল পর্যন্ত সময়ে মাত্র একটি বাউন্ডারি এসেছে। আসবে কোত্থেকে! ২২তম ওভারের তৃতীয় বলে তৃতীয় উইকেট হারানো বাংলাদেশ যে এরপর থেকেই ইনিংসে পথ হারিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *